কাঁঠাল কাণ্ড

বৃষ্টি ও প্রেম (সেপ্টেম্বর ২০২০)

Mkhasan
  • ৪৯
হবু বউয়ের নরম-কোমল হাতের স্পর্শে এক মধুর ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল কবিরুলের সমস্ত শরীর-মনে। কী যে মিষ্টি, প্রশান্তির সে পরশ তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সত্যি তাই এই অন্যরকম অনুভূতি প্রকাশের নয় কেবলই অনুভবের।
কাশফুলের মতো এমন কোমল পরশ পাওয়ার যাদের সৌভাগ্য হয়েছে শুধু তারাই অনুভব করতে পারে এই মধুর ভালোলাগা। হবু বউয়ের হাতটি অতি যত্নে আলতো করে ধরে কবিরুল অবাক হয়ে ভাবে, এটা কি এক পার্থিব মানবীর স্পর্শ নাকি কোন দেবীর স্বর্গীয় ছোঁয়া!
কবিরুলের অবাক হওয়ারই কথা। হবু বউ নিশির আগে অন্য কারও হাত ধরার চেষ্টা করেনি কবিরুল। চেষ্টা না করাই স্বাভাবিক। কারণ পড়ুয়া ছাত্র হিসেবে পরিচিত কবিরুলের জগতটাই ছিল পাঠ্য-পুস্তুক। পরিশ্রম করে ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। কবিরুল এখন এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার। পড়ুয়া ছাত্র পরিচয়ের বাইরে অবশ্য কবিরুলের আরেকটি পরিচিত আছে। সেটা হলো কাঁঠাল পাগল কবিরুল। কাঁঠাল ভীষণ পছন্দের ফল কবিরুলের। এমনি পছন্দ যে কাঁঠাল পেলে অন্য খাবারের ধারে-কাছে যান না তিনি। মাঝারি আকৃতির এক কাঁঠাল বিরতিহীনভাবে একাই সাবাড় করে ফেলেন। কোষের হিসেবে তাও ৮০ থেকে ১০০ টি হবেই! কাঁঠাল প্রীতি থেকে কবিরুল কাঁঠাল নিয়ে অনেক জ্ঞানও রাখেন, সুযাগ পেলে জ্ঞান বিতরণও করেন। সঙ্গত কারণে বন্ধু মহলে তিনি কাঁঠাল কবিরুল নামেও পরিচিত।
কাঁঠালপ্রীতি থেকে বেশ কিছু কাঁঠালকাণ্ডও ঘটিয়েছেন কবিরুল। তেমনি এক কাণ্ড ঘটান হবু বউকে অর্থাৎ নিশিকে দেখার অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত। এদিকে কবিরুলের খোঁজ নেই। ফোনও ধরছে না। এমন সময় চারটি কাঁঠাল নিয়ে হাজির। সবার প্রশ্ন এত কাঁঠাল কী হবে? কবিরুলের স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর, হবু শ্বশুর বাড়ি জাতীয় ফল নিয়ে যাব।
বাসাজুড়ে হৈচৈ পড়ে গেল, তবে বেশির ভাগেরই হাসির খোরাক জোগাল এই কাঁঠালকাণ্ড। বড় ভাই, বড় দুলা ভাই দুজনের সাফ কথা কাঁঠাল নিয়ে গিয়ে অপমানিত হতে পারব না। বড় ভাই হুশিয়ারী উচ্চারণ করলেন, কাঁঠাল নিয়ে তোর অনেক পাগলামি সহ্য করেছি, তাই বলে…। রাগে ফুসতে লাগলেন তিনি। বড় ভাবি বোঝাতে লাগলেন কবিরুলকে। কিন্তু কবিরুল বোঝালেন উল্টো সবাইকে। তোমরা তো জাতীয় ফলের মর্যাদা বোঝ না। আমার হবু শ্বশুর পরিবেশ বিষয়ক অধ্যাপক। কাঁঠাল নিয়ে গেলে উনি খুশিই হবেন। কবিরুল বড় মামার সমর্থন পেলেন। তিনি বললেন, অনুষ্ঠানে হয়তো কাঁঠাল কেউ নেয় না। কিন্তু আমরা নিলে অপমানিত হতে হবে -এটাও বোধহয় ঠিক না। তাছাড়া ওই বাড়ির সবাই উচ্চশিক্ষিত। মেয়েও পড়ে মেডিকেলে। আশা করি, এটাকে তারা ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করবেন। মামার কথা কেউ ফেলতে পারল না।
মিরপুর-২ থেকে মিরপুর-৬ সবাই রওনা হলো। চারটি কাঁঠালের একটি ভ্যানও দুটি প্রাইভেট কারের পিছু পিছু। পথে কেউ কেউ কাঁঠাল কিনতে চাইলো, দামও জিজ্ঞাসা করে। সিগনালে দাঁড়ালে কয়েকজন নেরেচেড়ে দেখল। মাঝবয়সী ভ্যানচালক কোন উত্তর দেয়না, কথা বলে না। শুধু বিরক্তিকর দৃষ্টিতে থাকায়।
বাসার সামনে গাড়ি দেখেই নিশির বাবা নিচে নেমে আসেন। সবাইেক স্বাগত জানান। কাঁঠালের ভ্যানও গেটে দাঁড়িয়ে। ভ্যানচালক সিটের ওপর বসে গামছায় ঘাম মুছছেন। কবিরুলের মামা নিশির বাবাকে একটু ফাঁকে নিয়ে কাঁঠাল বৃত্তান্ত খুলে বললেন। শোনার সাথে সাথে অবাক দৃষ্টিতে কবিরুলের দিকে তাকালেন তিনি। পরক্ষণেই হাসিমুখে দারোয়ানকে কাঁঠালগুলো উপরে নিয়ে যেতে বললেন।
সবাই বাসায় ঢুকে পড়েছে। দারোয়ান দুই হাতের তালুর উপর দুটি কাঁঠাল নিয়ে দোতলায় উঠতে লাগলেন। প্রায় উঠেও গেছেন। ইতোমধ্যে সিঁড়িতে হোচট খেয়ে ধপাস করে পড়ে গেলেন। জোরেসোরে থ্যাক করে একটি শব্দ হলো। কী হয়েছে, কী হয়েছ বলে সবাই দৌড়ে আসলো। এদিকে পাকা কাঁঠাল সিঁড়িতে পড়ে কোষগুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে। কোষে-রসে সিঁড়ি মাখামাখি, বেসামাল অবস্থা! দারোয়ানও আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন। সব শোনার পর নিশির বাসার সবাই আশ্চর্য দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর কবিরুলের স্বজনেরা বাসায় ঢুকে মাথা নিচু করে বসে আছেন। বড় ভাই রাগে গোমা সাপের মতো ফস ফস করছেন আর হাত-পা ছুঁড়ে বলছেন আগেই বলেছিলাম…। কবিরুলের ভাবি তাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন। আজকের দিনে কবিরুলের এমনিতে মাথা নিচু করে বসে থাকার কথা। বিব্রতকর ঘটনায় তার সেই নিচু মাথা উটপাখির মতো বালুর ভিতর গুঁজে রাখার অবস্থা। ওদিকে নিশিরও বড় ভাই রেগে ফুসছেন। ডাক্তারি পাশ করা একটা ছেলে এমন আনকালচরাড…ভাবতেই পারছি না। তাকেও তার স্ত্রী শান্ত করছেন। আর সব শুনে অন্দরমহলে নিশি হাসছেন মিটিমিটি।
বাসায় অতিরিক্ত কাজের লোকসহ মোট তিনজন সিঁড়ি পরিস্কারে লেগে পড়েছেন। ময়মনসিংহ এলাকার একজন বুয়া বক বক করছেন আর বলছেন, ‘কাডাল লইয়া কেউ মাইয়া দেকপার আইয়্যা এইডা পরতম দেকলাম’। সিঁড়ি বেয়ে লোকজন উঠছে আর জানতে চাইছে ঘটনা। এই বুয়া প্রাণখুলে ভাষণ দিয়ে চলছেন। ঘটনা শুনে উপহাসের হাসি সবার মুখে। ওদিকে দারোয়ান ব্যথানাশক মুভ ক্রিম ঘষছেন হাত-পায়ে।

যা হউক, এক পর্যায়ে কাঁঠালকাণ্ড শান্ত হলো। এবার আরম্ভ হলো বিয়ের কথাবার্তা। আগে থেকে কথা প্রায় পাকাপাকি ছিল। সম্পর্কে আত্মীয় হওয়ায় কবিরুল-নিশি দুজন দুজনকে চিনে আগে থেকেই। তাই সহজেই সবাই ঐক্যমতে পৌঁছলেন। বিয়ের দিন ধার্য হলো দুই মাস পর ঈদুল আযহার পরেরদিন। কবিরুলের বাবা নিশিকে আংটি পরিয়ে আশীর্বাদ করলেন। এবার ভুড়িভোজের পালা। পোলাও-কোর্মা-রোস্ট কোন কিছু বাদ নেই। কাঁঠালও কিন্তু বাদ পড়েনি। বোলভর্তি মাঝারি আকৃতির রসালো কোষ। সবাই একবার কাঁঠালের দিকে চায় আবার তাকায় কবিরুলের পানে, সাথে মুচকি হাসি। বিদায়বেলা কবিরুল-নিশি একান্তে দেখা করার সুযোগ পেলো। দুজন দুজনের দিকে তাকাতেই নিশি হাসতে থাকেন। কবিরুল নিচু গলায় জিঙ্গেস করেন হাসছেন কেন? তিনবার জিঙ্গেস করার পর নিশি উত্তর দেন, আপনি কাঁঠাল খেয়েছেন? কবিরুল বলেন, আপনিও মজা নিচ্ছেন। নিশি হাসতে থাকেন। কবিরুল বলেন, আপনি খেয়েছেন?
হবু স্বামী ভালোবেসে এনেছেন না খেয়ে কি পারি-বলেই হাসতে থাকেন নিশি। কবিরুল বিস্ময় চোখে নিশির দিকে তাকিয়ে থাকে।
নিশি-ওমনভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন?
কবিরুল-এই প্যাকটে কবিগুরুর কয়েকটা বই আছে। আপনার জন্য। এগুলোর মধ্যে আছে ‘শেষের কবিতা’। এই উপন্যাসে কবিগুরু বলেছেন, “উৎসজলের যে উচ্ছ্বলতা ফুলে উঠে, মেয়েটির কণ্ঠস্বর তারই মতো নিটোল। অল্প বয়সের বালকের গলার মতো মসৃণ ও প্রশান্ত”। আপনার এই হাসি শেষের কবিতা সেই লাবণ্যের মতো। এবার লজ্জায় লাল হয়ে যান নিশি।
কবিরুল-আমি আজ রাতেই রাজশাহী যাব অফিসে যোগদান করতে। ঢাকায় ফিরব এক মাস পর। দুজনের ফোন নম্বর, ফেসবুক আইডি, হোয়াটস আপ, ইমো আইডি বিনিময় হলো।
এই এক মাস ইন্টারনেটের সব মাধ্যম ব্যবহার করে চুটিয়ে প্রেম করেছেন কবিরুল-নিশি। এক মাস পর এসে নিশির হাতটি সেই যে ধরেছেন আর ছাড়ার কথা নেই। এমনি তো আর গানে গানে বলেনা,
“পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে জোড়া ছাড়ে না”।
নিশির হাত ধরেই ফুটপাতে হাটছে কবিরুল । হাত ধরাধরি করে হাটায় মাঝে মাঝে মানুষের গায়ের ঘেষাও লাগছে। নিশি অস্বস্তি বোধ করছে। বললেন, হাত ছাড়ো লোকে কী বলবে? রেশমের মতো মসৃন এমন হাতখানা কেউ কি ছাড়তে পারে-রোমান্টিক উত্তর কবিরুলের। হাত ধরেই উঠলেন সিএনজিতে। সিএনজিতে বসে নিশির হাতটি বুকে জাপটে ধরেন। পারলে বোধহয় কলিজার ভিতর ঢুকিয়েই নেয়। কবিরুল প্রথম কোন মেয়ের হাত ধরেছে বলে এত ভালো লাগছে সেটা একটা ব্যাপার। তাছাড়া নিশির হাতের সৌন্দর্য কিন্তু অসম্ভব আকর্ষনীয়। হাতের এক একটি অঙ্গুলি যেন রূপালি চাঁদের মতো মায়াবি। হালকা-পাতলা গঠনের নিশির মুখটিও মায়া জড়ানো। কাজলকালো মণির চারপাশ সাগরের টলটলে স্বচ্ছ জলের মতো। চোখে চোখে পড়লেই সেই চোখের মায়াজালে আটকে যেতে হয়।
সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখে দুজন সিএনজিতে বাসায় দিকে রওনা হলেন।
কাওরানবাজারে রাস্তা পুরোটা জ্যাম। জ্যাম থেকেই নিশির চোখ গেল ডানপাশে। দেখ দেখ তোমার কাঁঠাল। চাইলে কিনতে পারো। হাসতে হাসতে কবিরুল বলেন সিএনজি দাঁড় করানোর জায়গা থাকলে সত্যি সত্যি নেমে কিনে আনতাম। নামতে দিলে তো নিশি শক্ত করে হাত ধরে কবিরুলের। কাঁঠালের প্রসঙ্গ উঠলে লেকচার না দিয়ে থাকতে পারে না কবিরুল।
কবিরুল-আচ্ছা কাঁঠাল সম্বন্ধে তুমি কী জানো?
নিশি-কিছুই জানি না।
কবিরুল - জাতীয় ফল সম্বন্ধে সবারই বেসিক নলেজ থাকা উচিত। আচ্ছা আমি বলি শোন।
নিশি-এখন কাঁঠালনামা শুনতে পারব না, টায়ার্ড লাগছে।
কবিরুল- আচ্ছা সংক্ষেপে বলি, কাঁঠাল গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী ফল। কাঁঠালের বৈজ্ঞানিক নাম হলো আর্টোকার্পাস হেটেরোফিলাস। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ, পশ্চমিবঙ্গ, আসাম, দক্ষিণ ভারত, বিহার, মায়ানমার, মালয় এবং শ্রীলংকাতে কাঁঠাল গাছ বেশি জন্মায়। সাধারণত লালচে মাটি ও উঁচু স্থান কাঁঠালের প্রধান উৎপত্তিস্থল। বাংলাদেশের সব জায়গায় কাঁঠাল গাছ দেখা যায়, তবে মধুপুর, ভাওয়ালের গড় ও পাবর্ত্য এলাকায় কাঁঠাল বেশি জন্মে। নিশির চোখ ঘুম ঘুম। শুনছে কিনা ওদিকে খেয়ালই নেই কাঁঠাল পাগল কবিরুলের। গড় গড় করে বলেই চলেছে। এক পর্যায়ে ধাক্কা দিয়ে সজাগ করে নিশিকে।
নিশি- সরি, বলো শুনছি।
কবিরুল-শোন, এই অঞ্চলে কাঁঠালের জাত প্রধানত দুইটা গালা আর খাজা। গালা জাতের কাঁঠালের কোষগুলো ছোট আকৃতির, রসালো ও মিষ্টি হয়। আর খাজা জাতের কাঁঠালের কোষগুলো বড় আকৃতির, কম রসালো, কম মিষ্টি হয়। এই জাতের কাঁঠাল সহজে হজম হয় না বলে মানুষ কম পছন্দ করে। উইকিপিডিয়ায় এই দুই জাতের কাঁঠালের কথা উল্লেখ থাকলেও লোকমুখে কদমা, চাউলা, নরমসহ বিভিন্ন ধরনের কাঁঠালের বর্ণনা পাওয়া যায়। আচ্ছা কখনো কাঁঠাল দিয়ে পান্তা খেয়েছো?
নিশি কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বলেন ওটা আবার কোন খাবার হলো?
কবিরুল - খেলে এভাবে বলতে পারতে না। কাঁঠাল-পান্তার কী যে স্বাদ তা বুঝানো যাবে না। একবার খাওয়া শুরু হলো শেষ করতেই ইচ্ছে হয় না। তেমনি কাঁঠাল-মুড়ি, কাঁঠাল-চিড়া, কাঁঠাল-ছাতুও কম মজাদার খাবার নয়।
নিশি-আচ্ছা তোমাদের পরিবারের সবাই কি কাঁঠাল পছন্দ করে?
কবিরুল- না, তেমন পছন্দ করে না। তবে বাবা কাঁঠাল খেতে ভালোবাসসে।
নিশি-তার মানে তোমার বাবার কাছ থেকে এই আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
কবিরুল- না, আসলে ব্যাপারটা হলো, বড় ভাইয়ের বিয়ের পর তার শ্বশুর বাড়ি থেকে কাঁঠাল পাঠায়। সেই কাঁঠাল ভাঙ্গলে মৌ মৌ গন্ধ করতো। রস, স্বাদ গন্ধ একেবারেই আলাদা। একবার খেলে স্বাদ অনেকক্ষণ জিভে লেগে থাকতো। ঠিক তোমার মতো একেবারেই অন্যরকম বলে কবিরুল নিশির অধরে আলতো করে হাত ছুঁয়ে দেয়। নিশি হাত সরিয়ে বলে আর কিছু পেল না কাঁঠালের সাথে তুলনা। আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ময়না, টিয়া, গোলাপ, জবা, জুঁই, টিউলিপ…।
নিশি- অনেক হয়েছে তোমার কাঁঠাল কাহিনি শেষ করো।
কবিরুল-মূলত ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির ওই কাঁঠাল খাওয়ার পর থেকেই ফলটির প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়।
নিশি-ক্লান্ত কণ্ঠে বলে বুঝলাম। আর কিছু?
কবিরুল-আর একটু। না বলতে পারলে পেটে গ্যাস হবে।
নিশি- না, না, বলো শুনব।
কবিরুল- শোন, মানুষের মতো কাঠালেরও শিশু, কৈশোর এবং যৌবনকাল আছে। কাঁঠালের শিশুকালকে মুচি, কিশোরকালকে ইচড় এবং যৌবনকালকে কাঁঠাল বলা হয়।
একটি কবিতা শুনিয়ে শেষ করি-

কাঁঠাল
স্বাদ-রসে জিভে আসে জল
ডাকে তারে সবাই কাঁঠাল
তুমি যে গর্বের জাতীয় ফল।
স্বাদ ছাড়াও পাই তোমার বহু পুষ্টিগুণ
নানা রোগের ঔষধি তুমি
শক্তির সাথে আনো তুমি ভালো ঘুম।
ঘ্রাণ আর গন্ধে চারিদিকে করো মৌ মৌ
তোমায় খেয়ে মিষ্টি হাসে আমার হবু বৌ।

নিশি-জ্বি না, তোমার মতো আমি কাঠাল পাগল হতে চাই না। আর দুজনেই পাগল হলে সংসার সামলাবে কে?
কবিরুল – তার মানে আমি পাগল?
নিশি- সত্যি তো তুমি পাগল। তবে কাঁঠাল পাগল কবিরুল।
দুজনেই হাসতে থাকে।
সকালে নিশি কবিরুলকে জানায় তার খালা হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। দুজনে দেখভাল করলেন খালার। দুদিনেই মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন তিনি।
পরেরদিন বিকেলে নিশিকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে আসেন কবিরুল। পাশে একটি ফাস্টফুডে বসে পিৎজা-কফি খায়। নিশি বলেন, চলো স্টেডিয়ামের ওই দিকে যাই। বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। পশ্চিম পাশটা বেরিকেড দিয়ে আটকে দিয়েছে। বসে বসে বাদাম খাওয়ার উপযুক্ত জায়গা। কবিরুলেরও প্রিয় জায়গা ওটা। বলেন, শুধু খেলার সময় আটকে না রেখে এটাকে মিনি পার্ক বানালে কোন ক্ষতি দেখি না। আশেপাশে কোথাও শান্তি মতো বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। নিশিও সায় দেয় এতে। কবিরুলের চোখ হঠাৎ ডানপাশে ছয় নম্বর বাজার। গেটে ছোট-বড় কাঁঠালের মেলা। কী কী করতে করতেই নিশিকে নিয়ে কাঁঠালের সামনে হাজির। খুঁজছে ছোট আকৃতির কাঁঠাল।
নিশি-কাঁঠাল কী করবে এখন?
কবিরুল -খাব।
নিশি-কোথায় খাবে?
কবিরুল- স্টেডিয়ামের সামনে।
নিশি-পাগল হলে নাকি। আমি কিন্তু চলে যাব।
কবিরুল – আচ্ছা কিনে নিব। বাসায় খাব।
নিশি-তাহলে আমাকে এগিয়ে দিতে এসে কিনে নিও।
কবিরুল – না, না, এত সুন্দর কঁঠাল থাকে নাকি। আমি কিনে পলিথিনে রাখব।
নিশি-তুমি এই কাঁঠাল নিয়ে আমার সাথে ঘুরবে?
কবিরুল- আরে কাগজে মুড়িয়ে পলিথিনে নিলে কেউ বুঝতে পারবে না।
নিশি-তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। চরম বিরক্তি প্রকাশ করে নিশি।
কবিরুল -মামা দাম কত?
দোকানি-৬০ টাকা।
কবিরুল-১০০ টাকা দিব!
দোকানি-নিশি দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে কবিরুলের দিকে তাকিয়ে আছে।
কবিরুল -অবাক হওয়ার কিছু নেই। শর্ত কাঁঠাল ভালো হতে হবে।
দোকানি-‘আমি প্রতিবছর সাভারের একটা গৃহস্থ বাড়ি থাইকয়্যা এই কাঁঠাল আনি। আপনে নিশ্চিন্তে লইয়া যান। দরকার হলি খাইয়া দাম দিয়েন’।
দোকানি বেশি নিতে না চাইলেও কবিরুল একপ্রকার জোর করেই ১০০ টাকা দিল। নিশি এখনও অবাক হয়। ইতোমধ্যে এক মাঝবয়সী ব্যক্তি কাঁঠালের দামাদামি করছেন। দোকানি ১২০ টাকা দাম চাইল তিনি ৫০ টাকা দাম বলেন। ক্রেতার পানে রাগ রাগ চোখে তাকালো কবিরুল। আর দোকানি কোন কথা না বলে গোমরামুখে কাঁঠাল রেখে দিল।
কবিরুলের এক হাতে কাঁঠাল অন্য হাতে নিশির হাত।
কবিরুল-আচ্ছা বলতো এক কেজি সবজির দাম কত?
নিশি-মানে?
কবিরুল-জানো কি না?
নিশি-জানি না।
কবিরুল -এক কেজি করল্লা-বেগুনের দাম ৫০-৬০ টাকার আশপাশে উঠানামা করে। আমরা কি ৫০ টাকার বেগুন ২৫ টাকা দাম করি? তবে জাতীয় ফল কাঁঠালের বেলায় কেন এমন অবমাননা।
নিশি-তোমার কি কাঁঠাল কাহিনি আবার শুরু হলো?
কবিরুল – রাগ করো না শুনো। ৫০-৭০ টাকার এক কাঁঠাল পরিবারের ৫-৭ জন সদস্য ভরপুর খেতে পারে। আবার সেই কাঁঠালের কেজি খানেক বিচি সবজি হিসেবে অথবা ভেজে বা পুড়িয়ে খাওয়া যায়। আবার কৃষকেরা কাঁঠালের চুচাসহ অবিশিষ্ট অংশ গো খাদ্য হিসেবে কাজে লাগায়। যথারীতি গড় গড় করে বলেই চলেছেন কাঁঠাল পাগল কবিরুল। কাঁঠালের কত গুণ জানো?
নিশি-আমার জানার দরকার নেই। কোথায় বসবে বলো?
কবিরুল- কাঁঠাল অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ফল। কাঁঠালে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্কসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এছাড়া কাঁঠালে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন, শর্করা, আমিষ থাকায় তা মানবদেহের জন্য বিশেষ উপকারী।
নিশি-এবার শেষ করো তোমার কাঁঠাল কাহিনি। বসে পড়লেন নিশি। কবিরুলও বসলেন।
কবিরুল- তুমিও হয়তো জানো। তারপরেও বলি। দাঁতের মাড়ি শক্তিশালী করতে, হজম শক্তি বাড়াতে, সর্দি-কাশি, রাতকানা, উচ্চরক্তচাপ, আলসার, চর্মরোগ, বার্ধক্য, এমনকি ক্যান্সার প্রতিরোধেও কাঁঠাল বেশ উপকারী। কাঁঠালের বিচিও প্রচুর পষ্টিগুণে সমৃদ্ধ।
এখন তুমিই বলো একটি কাঁঠাল কিনতে এত কিপ্টেমি, দামাদামি কেন? আমি মনে করি জাতীয় ফলের মর্যাদা রক্ষার্থে ধান-চালের মতো কাঁঠালেরও দাম নির্ধারিত করে দেয়া উচিত। সর্বনিম্ন দাম হওয়া উচিত ৫০ টাকা। এতে করে চাষিরা কাঁঠাল উৎপাদনে আরো আগ্রহী হবেন। কবিরুলের আরো যুক্তি হলো, সস্তা জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ-আকর্ষণ কম থাকে আর দাম বাড়ার সাথে সাথে সমাজে তার মর্যাদা-মূল্যও বেড়ে যায়।
নিশি-আমি কিন্তু চলে যাব।
আচ্ছা আর একটা তথ্য জানিয়েই লেকচার শেষ করব। শোন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের বন-পাহাড়ে ক্যাম্প করা হয়। সেখানে খাদ্যের যোগান দেয়া সহজ ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা বনজঙ্গলের কাঁঠাল খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতো। তার মানে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও কাঁঠাল অনুসঙ্গ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। তুমিই বলো এই কাঁঠালকে ভালো না বেসে পারা যায়?
নিশি- তাহলে তোমার ভালোবাসার কাঁঠাল নিয়েই থাকা। আমার হাত ছাড়ো বলে ঝেংটি মেরে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
কবিরুল- সরি, এখন আর কাঁঠাল নয়। এবার শুধু তুমি আর আমি। মাঝে আর কেউ নেই। বাদাম কিনে খেতে শুরু করলো দুজন। ক্রিকেট খেলার দিনে এখানে মেলার মতো লাগে। যানবাহন নেই, আছে খাবার-খেলনার দোকান। আর আছে আইনশৃংখলা বাহিনীর টহল। স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইটের ঝলকানি। মাঝে মাঝেই চার-ছক্কা বা উইকেট পতনে হাততালি, শরগোল। কেমন লাগছে বলো?
নিশি- আরো ভালো লাগত যদি তোমার কাঁঠাল কেচ্ছা না থাকত।
কবিরুল -বললাম না আর কাঁঠাল নয়।
আচ্ছা কীসের একটা ঘ্রাণ আসছে না? কাঁঠালের নাকি?
নিশি-আবার কাঁঠাল?
কবিরুল – পলিথিনটা একটু খুলে দেখি।
কবিরুল পলিথিন খুলতে লাগল, ওদিকে নিশি মোবাইলে মনোযোগ দিল। পলিথিন খুলতেই একটা মৌ মৌ ঘ্রাণ এসে লাগল কবিরুলের নাকে। চোখ তুলে দেখে নিশি মোবাইলে মনোযোগী। ভাবলো এই সুযোগই ভেঙ্গে খেয়ে দেখতে হবে। যে ভাবনা, সেই কাজ। একবার দেখে নিশিকে, আবার ধরে কাঁঠালের কাণ্ড। এমন করতে করতে কাণ্ডটি ধরে ভাঙ্গতেই পলিথিন-পিচঢালা পথের সংঘর্ষে সাধের কাঁঠাল ছিটকে পড়ে গেল রাস্তার মাঝে। কিছু বুঝে উঠার আগেই টহলরত এক সার্জেন্ট সেই কাঁঠালে স্লিপ কেটে মোটরসাইকেল নিয়ে পড়লেন রাস্তার উপর। আর মোটরসাইকেল পড়ল কবিরুল-নিশির গায়ের উপর। সার্জেন্ট, নিশি, কবিরুল সহ আরেক পথচারী রক্তাক্ত। সবাইকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে।
সবাই ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। তবে নিশি-কবিরুলের পরিবার ভয় পাচ্ছে পুলিশি ঝামেলার। আহত সার্জেন্ট ও তার পরিবার মামলার ভয় দেখাচ্ছে।
পরেরদিন বিকেলে পুলিশের এক বড় কর্তা আসার খবরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেশ সাবধানী। এদিকে ভয়ে মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে কবিরুল-নিশির বাবা-মায়ের। আট-দশ জন পুলিশ নিয়ে সেই কর্তা ঢুকলেন সার্জেন্টের কেবিনে। সার্জেন্ট অভিযোগ করলেন। বড় কর্তা সব শুনে আশ্বস্ত করলেন। এরপর গেলেন নিশি-কবিরুলের কাছে। এমন সময় একটা লোক বিরাট এক কাঁঠাল নিয়ে হাজির। সবার চোখ তো ছানাবড়া। এখানেও কাঁঠাল? পুলিশের কর্তা বললেন, আমি সব শুনেছি। তিনি আরও জানালেন, আমারও ভীষণ পছন্দ জাতীয় ফল কাঁঠাল। তিনি কবিরুলের কানে ফিস ফিস করে বললেন, কাঁঠালের জন্য এমন সুন্দরী বউ হারানোর ঝুঁকি নেয়া কি উচিৎ?
এবার সবার মুখেই খুশির হাসি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অনবদ্য লেখা ,পড়ে বিমোহিত হলাম।
ভালো লাগেনি ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

০৭ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪